নীরব দৃষ্টির প্রেম | এক আবেগী কলেজ প্রেমের গল্প

 

silent-love-story-thumbnail.jpg
silent-love-story-thumbnail.jpg

নীরব দৃষ্টির প্রেম

আমার নাম শ্রেয়া।
আমি একজন সাধারণ কলেজছাত্রী। জীবনটাও খুব সাধারণ—ক্লাস, পড়াশোনা, নোটস, পরীক্ষার চিন্তা, আর মাঝেমধ্যে জানালার ধারে দাঁড়িয়ে নিজের মনটাকে একটু বিশ্রাম দেওয়া। আমি থাকি রানাঘাট, পশ্চিমবঙ্গে। আমাদের বাড়িটা খুব বড় নয়, কিন্তু আলো-বাতাসে ভরা। বাড়ির পাশেই আছে একটি সাদা রঙের দোতলা বাড়ি, যেটা আমার জীবনের গল্পটা একদম অজান্তেই বদলে দিয়েছিল।

ওই বাড়িটার ছাদে একটা বড় ফুলের টব ছিল। রোজ সকালে সেখানে জল দেওয়া হতো। প্রথম প্রথম সেটা চোখেই পড়েনি। কিন্তু ধীরে ধীরে আমি লক্ষ্য করতে শুরু করলাম—প্রায় প্রতিদিন সকালে একই সময় একজন তরুণ ছাদে আসে। সে খুব বেশি কিছু করে না। কখনো ফুলে জল দেয়, কখনো চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকে। যেন আকাশের সঙ্গে নিজের কোনো নীরব কথা চলছে।

আমি তখন কলেজের দ্বিতীয় বর্ষে। সকালবেলায় ক্লাসের জন্য তৈরি হওয়ার সময় জানালা খুলে বাইরে তাকানোটা আমার অভ্যাস ছিল। সেই অভ্যাস থেকেই প্রথম তার দেখা। একদিন, দুইদিন, তারপর প্রতিদিন।

সে আমাকে দেখত কি না, আমি জানতাম না। আমিও খুব বেশি তাকাতাম না। কিন্তু অদ্ভুতভাবে, তার উপস্থিতিটা আমার সকালগুলোর অংশ হয়ে গেল।

সময় কেটে যাচ্ছিল। পড়াশোনার চাপ বাড়ছিল। জীবনের অনিশ্চয়তা, ভবিষ্যৎ নিয়ে দুশ্চিন্তা—সব মিলিয়ে মনটা ভারী থাকত। কিন্তু ওই ছাদটার দিকে তাকালেই যেন একটু হালকা লাগত। কোনো কারণ ছাড়াই।

একদিন হঠাৎ আমাদের চোখে চোখ পড়ল।

আমি তখন জানালার ধারে দাঁড়িয়ে বই হাতে। সে ছাদে ছিল। চোখাচোখির মুহূর্তটা খুব ছোট ছিল, কিন্তু আমার মনে হলো সময় যেন থেমে গেছে। আমি দ্রুত চোখ সরিয়ে নিলাম। বুকের ভেতর অদ্ভুত একটা ধাক্কা খেল।

সেদিন সারাদিন পড়ায় মন বসেনি।

এরপর থেকে বিষয়টা বদলে গেল। আমরা দু’জনেই জানতাম—আমরা একে অপরকে দেখছি। কিন্তু কেউই কোনো সীমা লঙ্ঘন করিনি। কোনো অপ্রয়োজনীয় ইশারা, কোনো অস্বস্তিকর আচরণ—কিছুই না। শুধু নীরবতা।

নীরবতার মধ্যেও যে কত কথা লুকিয়ে থাকে, সেটা তখন বুঝিনি।

কিছুদিন পর সে হালকা করে মাথা নেড়ে শুভেচ্ছা জানাল। খুব সাধারণ, খুব ভদ্র। আমি একটু লজ্জা পেয়ে একইভাবে মাথা নেড়েছিলাম। সেই ছোট্ট মুহূর্তটা যেন অনেক বড় কিছু হয়ে রইল।

এরপর থেকে আমরা দূর থেকেই একে অপরের উপস্থিতি টের পেতাম। সে ছাদে এলে আমি জানালার ধারে আসতাম। আমি না এলে সে বুঝে যেত। কোনো কথা না বলেও আমরা যেন একে অপরের দৈনন্দিন রুটিনের অংশ হয়ে উঠেছিলাম।

আমার বন্ধুদের সঙ্গে গল্প করলেও তার কথা কাউকে বলিনি। কারণ এটা তখনো নামহীন ছিল। ভালোবাসা? নাকি কৌতূহল? নাকি শুধু একাকীত্বের মধ্যে পাওয়া একটা শান্ত অনুভূতি?

একদিন বিকেলে হঠাৎ দরজায় কড়া নাড়ার শব্দ।

আমি খুলে দেখি—সে দাঁড়িয়ে। একটু অপ্রস্তুত লাগছিল তাকে। খুব ভদ্রভাবে বলল,
“আমি পাশের বাড়ির। আপনার বাবার সঙ্গে একটু কথা ছিল।”

আমি জানতাম বাবা তখন বাইরে। কিন্তু তাকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেওয়া ঠিক মনে হয়নি। ভেতরে বসতে বললাম। সে সোফায় বসল, চোখ নামানো। যেন পরিস্থিতিটা নিয়ে নিজেও দ্বিধায়।

কিছুক্ষণ পর সে বলল,
“আসলে… আমি ভুল কিছু ভাববেন না। আমি শুধু বলতে চেয়েছিলাম—আপনি খুব শান্ত। আপনার চোখে একটা আলাদা গভীরতা আছে। সেটা আমাকে ভালো লাগে।”

আমি কী বলব বুঝতে পারিনি। এই কথার মধ্যে কোনো অশোভনতা ছিল না। ছিল না কোনো দাবি। শুধু একরাশ সততা।

আমি শুধু হেসেছিলাম। আর সেই হাসির মধ্যেই যেন অনেক কিছু বলা হয়ে গিয়েছিল।

সেদিন সে চলে যাওয়ার পর আমি অনেকক্ষণ চুপ করে বসে ছিলাম। নিজের মনটাকে বোঝার চেষ্টা করছিলাম। ভয়ও ছিল—এই অনুভূতি কি আমাকে দুর্বল করে দেবে? নাকি শক্ত?

পরের দিন থেকে আমাদের কথা শুরু হলো। খুব ধীরে। খুব সাবধানে। কখনো গেটের সামনে, কখনো ছাদে দূর থেকে। সে নিজের কথা বলত। বলত, সে চাকরির চেষ্টা করছে। নিজের পরিবার, নিজের দায়িত্ব নিয়ে। আমি বলতাম আমার পড়াশোনা, আমার স্বপ্নের কথা।

আমরা দু’জনেই জানতাম—এই সম্পর্কটা হালকা নয়। কিন্তু আমরা এটাকে তাড়াহুড়ো করিনি। সময়কে সময় দিয়েছিলাম।

কখনো কোনোদিন কথা না হলেও মন খারাপ হতো না। কারণ বিশ্বাসটা তৈরি হয়ে গিয়েছিল। আমরা কেউই একে অপরকে দখল করতে চাইনি। শুধু পাশে থাকতে চেয়েছি।

বর্ষার দিনগুলোতে ছাদে ফুলগুলো আরও সুন্দর হয়ে উঠত। আমি জানালা দিয়ে তাকিয়ে থাকতাম। সে আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকত। মাঝে মাঝে মনে হতো—এই নীরবতাই আমাদের সবচেয়ে বড় সংযোগ।

সময় গড়াল। পরীক্ষাও এলো, গেল। জীবনের চাপ বাড়ল। কিন্তু এই সম্পর্কটা চাপ হয়ে দাঁড়ায়নি। বরং আশ্রয় হয়ে উঠেছিল।

একদিন সে বলল,
“আমি জানি না ভবিষ্যৎ কী। কিন্তু আমি চাই—যদি কোনোদিন তুমি দুর্বল হও, আমি যেন পাশে থাকতে পারি।”

আমি তখন বুঝলাম—ভালোবাসা মানে প্রতিশ্রুতি নয়, উপস্থিতি।

আজও আমরা নিশ্চিত নই ভবিষ্যৎ নিয়ে। কিন্তু এটুকু জানি—এই সম্পর্কটা আমাদের দু’জনকে আরও মানুষ করেছে। আরও সংবেদনশীল।

ভালোবাসা সব সময় নাটকীয় হয় না। কখনো সেটা খুব শান্ত হয়। খুব নীরব।

আর সেই নীরব প্রেমই কখনো কখনো সবচেয়ে গভীর হয়।

Previous Post Next Post

نموذج الاتصال